ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: চলতি এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তহে খোলা চিনির দাম ১০৪ টাকা কেজি নির্ধারণ করে সরকার। তবে এ দামে রাজধানীসহ দেশের কোথাও চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। বাজারগুলোতে ১০৪ টাকার খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা দরে। এছাড়া প্যাকেটজাত চিনি ১০৯ টাকা নির্ধারণ করলেও বাজারে এ চিনির সরবরাহ নেই বললেই চলে।
ভোক্তারা বলছেন, সরকারী নির্দেশনার বাস্তবায়ন নেই চিনির বাজারে।
এদিকে ভোক্তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলছে, আইনের সঠিক প্রয়োগ এবং বাস্তবায়ন না থাকায় অসাধু ব্যবসায়ীরা নিজেদের মতো অপরাধ জগত তৈরি করেছে। যেখানে সরকারের সিদ্ধান্তও অসহায়ত্ববোধ করে।
রাষ্ট্রায়ত্ত বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজার তদারকি প্রতিবেদন অনুযায়ী, খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হয়েছে ১১৫-১২০ টাকায়। তবে সরকারের এই সংস্থার দেওয়া তথ্য অনুসারে রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা যায়, ঢাকা মহানগরীর কোথাও ১১৫ টাকায় চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি ডিপার্টমেন্টাল স্টোর স্বপ্ন সুপারশপেও প্রতি কেজি খোলা চিনি ১১৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর প্যাকেটজাত চিনি বাজার থেকে উধাও।
গত ৬ এপ্রিল চিনির দাম কেজিতে তিন টাকা কমানোর ঘোষণা দেয় সরকার। সেই ঘোষণা অনুযায়ী প্রতি কেজি খোলা চিনি ১০৪ টাকা ও প্যাকেটজাত চিনি ১০৯ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা।
পাইকারী বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৫০ কেজি ওজনের চিনির বস্তার পাইকারী দাম নেওয়া হচ্ছে পাঁচ হাজার ৯৫০ টাকা। সে হিসেবে প্রতি কেজি চিনির পাইকারী দাম পড়ছে ১১৯ টাকা। খুচরা ব্যবসায়ীরা এলাকাবিশেষে কোথাও ১২০, কোথাও ১২৫, আবার কোথাও ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা কেজি বিক্রি করছেন।
রাজধানীর মালিবাগ, মগবাজার, শান্তিনগর, কাওরানবাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটি দোকানেই খোলা চিনি রয়েছে। তবে দাম সরকার নির্ধারিত থেকে বেশি। প্রতি কেজি ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা। এছাড়া প্যাকেটজাতের মধ্যে ফ্রেশ, নাম্বার ওয়ান, ইগলু ব্র্যাণ্ডের চিনি কয়েকটি দোকানে পাওয়া যায়। এসব প্যাকেট চিনি সরকার নির্ধারিত দাম ১০৯ টাকা হলেও দোকানীরা বিক্রি করছেন ১২৫ থেকে ১৩০ টাকা। অথচ প্যাকেট মূল্য লেখা রয়েছে ১০৯ টাকা।
মূল্যের থেকে বেশি নেওয়ার কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা জানান, ডিলার পর্যায়ে প্যাকেটজাত চিনির দাম বেশি। তাই বাধ্য হয়ে মূল্যের থেকে বেশি দাম নিচ্ছে।
এছাড়া রাষ্ট্রায়াত্ত চিনিকলগুলোতে উৎপাদিত লাল চিনি বাজারে নেই বললেই চলে। কাওরানবাজার ঘুরে একটি দোকানে লাল চিনি পাওয়া যায়। প্যাকেটে ২২৫ টাকা দাম লেখা থাকলেও বিক্রি করছেন ২৪০ থেকে ২৫০ টাকা দরে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমানে লাল চিনির কোনো সাপ্লাই নেই।
বিক্রেতারা জানান, মিল থেকে ইনভয়েসে সরকার নির্ধারিত দাম নেওয়া হলেও আন্ডার ইনভয়েস বাড়তি দাম নেওয়া হচ্ছে। বেশি দামে কেনা বলেই তারা বাধ্য হয়ে বাজারে বেশি দামে বিক্রি করছেন।
মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হাজি বশির উদ্দিন বলেন, ‘চিনির দাম হঠাৎ বাড়তি। সরকার যে ট্যাক্স কমিয়েছিল, তা তুলে দেওয়া হবে—এমন গুজবে চিনির বাজার উল্টাপাল্টা হয়ে গেছে। মিলাররাও বাড়তি লাভ ছাড়া বিক্রি করছেন না।
দেশবন্ধু গ্রুপের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা বলেন, চিনির শুল্ক প্রত্যাহার হলেও বিশ্ববাজারে দাম স্থিতিশীল নয়। তারপরও মিল থেকে চিনি সরকার নির্ধারিত দামে সরবরাহ করা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, মার্কেটিংয়ের সমস্যায় সেই সুফল ভোক্তারা পান না। ট্রেডারদের নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। তারা মিল থেকে নিয়ে মার্কেটে বেশি দামে বিক্রি করছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, দেশে বছরে চিনির চাহিদা ১৮-২০ লাখ টন। রোজায় এ চাহিদা আরও বেড়ে যায়। অথচ দেশে সব মিলিয়ে উৎপাদিত হয় মাত্র ৩০-৩৫ হাজার টন। শুধু রোজার মাসে চিনির চাহিদা বেড়ে দাঁড়ায় আড়াই থেকে তিন লাখ টন। দেশে উৎপাদন না থাকায় চাহিদার বড় অংশই জোগান দেওয়া হয় আমদানির মাধ্যমে।
‘সরকার নির্ধারিত দামে বাজারে চিনি পাওয়া যাচ্ছে না’ এ বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি গত ১৬ এপ্রিল বলেছেন, আমরা সম্প্রতি লক্ষ্য করেছি চিনির দাম একটু ঊর্ধ্বমুখী। আমরা বলেছিলাম চিনির দাম পাঁচ টাকা কমানো হোক। পরবর্তীকালে হিসাব-নিকাশ করে দেখা যায় তিন টাকা ৫০ পয়সা কমানো যায়। যখনই এটা আলোচনা চলছিল তখনই চিনির দাম আবার বাড়ানো হয়। রমজানের শেষ দিকে ঈদ ঘিরে চিনির চাহিদা বেড়েছে। যে কারণে দামও বেড়েছে। দাম যে বেড়েছে এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (আমদানি ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য অনুবিভাগ) মো. রুহুল আমিন বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে সব ধরনের চেষ্টা করা হচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে চেষ্টার কোনো ত্রুটি নেই। বাজার নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে বাণিজ্যমন্ত্রণালয়।
এদিকে ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষায় সরকারের পক্ষ থেকে সরাসরি কাজ করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। সরকারের এই সংস্থা চিনি রিফাইনারী কোম্পানি, আমদানিকারক, ডিলার এবং পাইকারী ব্যবসায়ীদের নিয়ে কয়েক দফা আলোচনা সভা করেছে। এছাড়া বাজার মনিটরিং করে দাম নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেছে। তবে এর কোনো ফলই পায়নি সাধারণ ভোক্তারা। অসাধু ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি হয়ে বেশি দামেই চিনি কিনছেন ক্রেতারা।
ভোক্তা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষায় নিয়মিত কাজ করছে ভোক্তা অধিকার। চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত অভিযান চালানো হয়েছে। অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভাঙতে আবারও অভিযান চালানো হবে।
কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, চিনির বাজার অনেক আগে থেকেই অস্থির। এর আগেও সরকার চিনির দাম নির্ধারণ করেছিল। তখনও নিয়ন্ত্রণে ছিল না। পরে আবার তিন টাকা কমিয়ে চিনির বাজার দর নির্ধারণ করে সরকার। তবে তিন টাকা কমাতে গিয়ে বাজারে আরও দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। চিনির বাজারে প্রথম থেকেই জোরালো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এর জন্য এই বাজার এখন ধরাছোঁয়ার বাহিরে চলে গেছে। বাজারে এখন ১২০ থেকে ১২৫ টাকাতে চিনি পাচ্ছে না ভোক্তারা।
তিনি বলেন, সরকার ব্যবসায়ীদের বার বার হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু হুমকি না শুনলে কি হবে সে বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এটা না করার কারণে অসাধু ব্যবসায়ীরা বেপরোয়া হয়ে গেছে। চিনির বাজার ব্যবসায়ীরা তাদের মতো করে পরিচালিত করছে। রমজানের শেষ সময়ে চিনির চাহিদা বেশি থাকে। আর যেহেতু ব্যবসায়ীরা নিজেদের মতো করে বাজার পরিচালনা করছে তাতে ভোক্তারা অসহায় হয়ে পড়েছে।
তিনি আরও বলেন, এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের বিষয়ে আমরা বার বার বলে আসছি, গুটি কয়েক অসাধু ব্যবসায়ী, যারা সরকারের সিদ্ধান্ত মানে না। তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত। ‘অপরাধ করলে শাস্তি পেতে হবে’ এই বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারলে এ ধরনের ঘটনাগুলো বার বার ঘটবে না। আমরা মনে করি সরকার সে দিকে এগিয়ে যাবে। তা না হলে আইনের শাসন বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে যাবে। দেশের অন্যান্য সেক্টরে অপরাধগুলো ছড়িয়ে পড়বে।